• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সারা দেশ

ভালো নেই বাওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

কালীগঞ্জ(ঝিনাইদহ)প্রতিনিধি:

ঝিনাইদহ ও যশোরের ৬ বাওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায় ভালো নেই। তাদের ভালো থাকার একমাত্র সম্বল বাওড়। সেটা গত এপ্রিল মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় কেড়ে নিয়ে ইজারা দিয়েছে। যে কারণে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ইজারাদাররা বাওড় গুলিতে কৃত্রিম উপায়ে মাছ উৎপাদন করায় জীববৈচিত্র্য ও দেশি জাতের মাছ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

 ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ও জয়দিয়া, মহেশপুরের কাঠগড়া ও ফতেপুর, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং যশোরের চৌগাছা উপজেলার বেড়গোবিন্দপুর বাওড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে মৎস্য অধিদপ্তরের চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৯ সাল থেকে মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়। এখানে সুবিধাভোগীরা ছিলেন বাওড় পাড়ের জেলেরা। ১৯৮৬ সাল থেকে বাওড়গুলি রাজস্ব খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে আরও কয়েক দফা চুক্তি বৃদ্ধি করে ভূমি মন্ত্রণালয়।

ইজারা দেয়া বাওড়ে উৎপাদিত মাছের ৩৫ শতাংশ পেতো মৎস্য অধিদপ্তর, ২৫ শতাংশ ভূমি মন্ত্রণালয় এবং জেলে সম্প্রদায় পেতো ৪০ শতাংশ। প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত রাণি মাছের একশ’ ভাগই পেতো বাওড় পাড়ের জেলেরা। সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে মৎস্য মন্ত্রণালয়ে চুক্তির মেয়াদ ছিল চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। পরে আর ভূমি মন্ত্রণালয় চুক্তি বৃদ্ধি না করে আগের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এই ছয়টি বাওড় ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করে।

এপ্রিলে ইজারাদারদের বাওড় বুঝিয়ে দেয়া হয়। জলমহল ইজারা প্রদানের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধনকৃত ও প্রকৃত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির আবেদনের কথা বলা হলেও এখানে একাধিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মৎস্যজীবী নন এমন ব্যক্তিদের বাওড় ইজারা পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

বাওড় পাড়ের জেলেরা কেমন আছে জানতে সরেজমিনে এ প্রতিবেদককে কোটচাঁদপুর জয়দিয়া বাওড় পাড়ে গেলে দেখা যায় ঘাটে প্রচুর জেলে ও তাদের পরিবারের লোকজন দাড়িয়ে বাওড়ের দিকে চেয়ে আছে। এই প্রতিবেদককে দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। জয়দিয়া বাওড় ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল কুমার হালদার বলেন, ‘আর সংসার টানতে পারছি না। বাওড় নেই, আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বাওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আমাদেরকে বড় করেছেন। বাবা তিন বছর আগে গত হয়েছেন। আমরা বাওড় পাড়ের জেলেরা এই কাজই শিখে বাওড়ের মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্য ছয়জন। ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়ে পড়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাওড় পাড়ের জেলেরা আগে বাওড়ের উৎপাদিত বড় মাছের ৪০ শতাংশসহ প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত বাওড়ের রাণিমাছ ধরে সম্পূর্ণ নিজেরা নিত। এখন সে রানি মাছগুলি ধরা তো দূরে থাক ইজারাদাররা আমাদেরকে বাওড়েও নামতে দেয় না। কী করবো ঝুঝে উঠতে পারছিনা। এখন দেখছি আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই।’বলুহর বাওড় ও মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল হালদার বলেন, ‘আমরা বাওড় পাড়ের মৎস্যজীবীরা কর্মক্ষম হয়ে গেছি। বাবা-দাদারা এ বাওড় থেকে মাছ ধরেই সংসারের খরচ যোগাতেন। আমরাও একই পেশাতে ছিলাম। বাওড় না থাকায় একেবারেই পথে বসে গেছি।’ তিনি বলেন, ‘একই অবস্থা প্রায় ছয় বাওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের।’ ফতেপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শান্তি হালদার বলেন, ‘আমরা ধারদেনা করে বাওড়টি ইজারা নিয়েছি। মাছ ছেড়েছি, সামনে কপালে কী আছে বলতে পারছিনা।’জয়দিয়া বাওড়ের সাবেক মৎস্যজীবীদের দলপতি নিত্য হালদার বলেন, ‘বাঁওড় পূর্বের ন্যায় ফিরে পেতে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। তারপরও ইজারাদাররা বাওড় পাড়ের জেলেদের মারধোর করে জোরপূর্বক মাছ ধরছেন।’

যশোর বিল বাওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন, ‘এ বাওড় গুলি আমাদের আওতায় ৪২ বছর ছিল। সে সময় বাওড় পাড়ের জেলেদের আর্থসামাজিক মান উন্নয়নে কাজ করে গেছে প্রকল্পটি। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাওড়ের বড় মাছের চাষ ও দেশিয় ছোট মাছের প্রজনন ঘটিয়ে নানা প্রজাতির মাছের চাহিদা মিটাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি। বাওড়টি রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। বাওড়গুলি ভূমি মন্ত্রণালয় ইজারা দিয়ে দিয়েছে। যে কারণে বাওড়পাড়ের জেলেরাতো বেকার হয়েছে, পাশাপাশি বাওড় সংশ্লিষ্ট ১৩০ থেকে ১৪০ জন দৈনিক মুজুরি ভিত্তিক কর্মীও বেকার হয়ে গেছে। বর্তমানে এ বাওড় কেন্দ্রিক আমাদের আর কিছুই করার নেই।’

বলুহর বাওড়ের ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাওড় গুলিতে মাছ চাষ করতাম মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাইজ ও সংখ্যা বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মাছ ধরার সময়ও নির্দ্ধারণ করা থাকতো, ছোট মাছ ধরা হতোনা। একইসাথে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য তথা বিলুপ্ত প্রায় মাছ সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম করা হতো। সেই সাথে প্রজননকালীন সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখা হতো। ফলে একদিকে বিপন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতো, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হতো। বর্তমান ইজারাদারা এ বিষয়ে যতœশীল না হয়ে অধিক মুনাফার জন্য কৃত্রিম উপায়ে মাছ চাষ করছেন। যখন তখন মাছ ছাড়ছেন এবং ধরছেন। যে কারণে দেশি মাছ ও জীববৈচিত্র্য বাওড়গুলি থেকে একেবারে ধ্বংস হতে বসেছে।’কৃষকরা জানিয়েছেন, কোটচাঁদপুর বলুহর বাওড় সংলগ্ন সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য বাওড়ের আশপাশে আবাদী জমির পানি স্যালো পাম্পের মাধ্যমে বাওড় থেকে নেয়া হতো। ইজারাদাররা এই পানি বাওড় থেকে নেয়া বন্ধ করতে বিভিন্ন ফন্দি ফিকিরি করছেন।’

একাধিক আবাদী জমির মালিক আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, বাওড় থেকে পানি নেয়া বন্ধ করে দিলে একদিকে যেমন শ’শ’ একর জমি চাষ বাধা গ্রস্থ হবে, অন্যদিকে সরকারি মৎস্য হ্যাচারি কমপ্লেক্সও পড়বে পানি সংকটে।’

বলুহর বাওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদার বলেন, বাওড় থেকে পানি উত্তোলন কেউ যেন না করতে পারে সেজন্য ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছি। আমার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি কাউকে ইজারা পাইয়ে দেয়নি বা আমরা বাওড় সাব-লিজও দেয়নি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads